গাছের কি বুদ্ধি আছে? প্রশ্নটি শুনে হাস্যকর মনে হলেও বিজ্ঞানীরা এর সত্যতা পেয়েছেন। গাছের বুদ্ধিমত্তা ও আচরণ নিয়ে গবেষণা করছেন এমন একজন বিজ্ঞানী হলেন স্টেফানো মানচুসো। তিনি একজন প্লান্ট নিউরোবায়োলজিস্ট। উদ্ভিদের বুদ্ধিমত্তা, অন্য উদ্ভিদ ও বাহ্যিক পরিবেশের সাথে উদ্ভিদের আচরণ নিয়ে তিনি গবেষণা করেন। গাছ নিয়ে এমন গবেষণা প্রথমদিকে খুব বিতর্কিত ছিল। এমনকি অনেক বিজ্ঞানী এই বিষয়কে হাস্যকর বলে মন্তব্য করেছেন।
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় স্টেফানো মানচুসো তার গবেষণা নিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সাংবাদিক অ্যামি ফ্লেমিংয়ের নেয়া সাক্ষাৎকারে স্টেফানো মানচুসোর গবেষণার চিত্র ফুটে উঠেছে। ফ্লেমিং উল্লেখ করেছেন, “আমি প্রত্যাশা করেছিলাম ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরেন্সে স্টেফানো মনচুসোর নিজ গবেষণাগারে বসে আমি তার সাক্ষাৎকার নিবো। ছবিতে যতটুকু দেখেছি তাতে তার গবেষণাগারকে আমরা কাছে উদ্ভিদের জাদুঘর মনে হয়েছে। যেন বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদকে তাদের বুদ্ধিমত্তার জন্য বিশেষ বিশেষ সম্মান দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যেখানে গাছের বুদ্ধিমত্তার উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে লজ্জাবতি গাছকে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি সবুজ শ্যামল উদ্ভিরাজির আচরণ অন্য জীবের সাথে তুলনা করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের গবেষণাগার পর্যবেক্ষণের সুযোগ রয়েছে।” তবে প্রত্যাশা থাকলেও অ্যামি ফ্লেমিং সরাসরি বিজ্ঞানী স্টেফানো মানচুসোর সাক্ষাৎকার নিতে পারেন নি। লকডাউনে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিনি স্টেফানো মানচুসোর সাথে স্কাইপিতে কথা বলেন। অ্যামি ফ্লেমিং বলেন, “ভিডিও কলে তার সংগ্রহশালার চালাক উদ্ভিদের বিশাল সংগ্রহশালা একসাথে দেখতে না পেলেও আমি নাগলিঙ্গমের উদ্ভিদের মতো বীজ (পড) দেখলাম। তার পাশের বইয়ের তাকে বীজগুলো রাখা ছিল। তিনি বলছিলেন যে আমি এই বীজগুলো অঙ্কুরোদগমের জন্য রেখে দিয়েছি, প্রতিনিয়ত আমি বিভিন্ন ফসলের বীজ সংগ্রহ করি।
২০০৫ সালে মনচুসোর গবেষণা শুরু হওয়ার পূর্বে প্লান্ট নিউরোবায়োলজি বিষয়টি হ্যাস্যকর বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তিনি বলেন, প্রথমদিকে অন্য প্রাণী ও মানুষের মতো গাছের বুদ্ধিমত্তার তুলনা করতে গিয়ে যে সকল বিতর্কিত বিষয় উথাপিত হতো তা নিয়ে আমরা খুব আগ্রহী ছিলাম। সেসময়ে গাছের আচরণ ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিজ্ঞানমহলে আলোচনা করার বিষয়ে একপ্রকার নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু আমরা আমাদের গবেষণা চালিয়ে গেছি। কিভাবে গাছ বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে, কিভাবে বিভিন্ন ঘটনা মনে রাখে, কিভাবে তারা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে, কিভাবে তারা তাদের নিজস্ব পরিবেশ বা পরিবর্তিত পরিবেশে টিকে থাকে তা নিয়ে আমরা গবেষণা করি।”
মনচুসো ও তার সহকর্মীরা গাছ নিয়ে অভিনব সব গবেষণায় বেশ অভিজ্ঞ। পরীক্ষাগারে গবেষণার জন্য ইঁদুরকে যেভাবে প্রশিক্ষিত করা হয়, তেমনভাবে তারা গাছকে গবেষণাগারে প্রশিক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছেন। বাহ্যিক প্রভাবক প্রয়োগ করে গাছের শরীরবৃত্তিয় পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি তাদের বাহ্যিক আচরণ পর্যবেক্ষণের কৌশল সম্পর্কে তারা দক্ষ। বাহ্যিক প্রভাবকের উপস্থিতিতে কোনো একটি উদ্ভিদ বিভিন্ন প্রকার আচরণ করে। লজ্জাবতি গাছের প্রকৃতি নিয়ে বলা যেতে পারে। নির্দিষ্ট নিয়মে বাইরের কোনো মাধ্যমের স্পর্শ পেলে লজ্জাবতি গাছের পাতা কুঁকড়ে যায়। আপনি যদি লজ্জাবতি গাছের উপর পানি ঢালতে থাকনে তাহলে দেখা যাবে পাতাগুলো লজ্জায় কুঁকড়ে গেছে। তবে একটানা কিছুক্ষণ পানি ঢালতে থাকলে কিছুক্ষণ পর পাতা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। অর্থাৎ লজ্জাবতি গাছের পাতা বুঝতে পারে এই পানি তার জন্য ক্ষতিকর না। ফলে পাতা না কুঁকড়িয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। পাশাপাশি বাইরের কোনো প্রভাবক ক্ষতিকর না উপকারী এই তথ্য গাছ বেশ কিছুদিন মনে রাখতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে মনে রাখার সময়কাল কয়েক দিন থেকে কয়েক মাস হতে পারে।
উদ্ভিদের বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া মনে রাখতে পারার এই ক্ষমতা বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছে। ইতিপূর্বে মনে করা হতো মানুষ বা অন্য প্রাণীর মতো উদ্ভিদের কোনো স্মৃতিশক্তি নেই । তাহলে কিভাবে তারা মনে রাখবে? আবার কেনইবা তাদের এই মনে রাখার সময়কাল কয়েক মাস অবধি হবে? যেখানে কীটপতঙ্গের গড় স্মৃতি সময়কাল এক থেকে দুই দিন। বিজ্ঞানী মনচুসো বলেন, “উদ্ভিদের এতদিন মনে রাখার ক্ষমতা আমাদের বিষ্মিত করেছে। আমরা ভাবতাম উদ্ভিদ কোনো প্রভাবকের উপস্থিতি বা প্রতিক্রিয়া অতি সামান্য সময় মনে রাখে। যেখানে মষ্তিষ্ক থাকা সত্ত্বেও কীটপতঙ্গ গড়ে এক থেকে দুই দিন মনে রাখে, সেখানে মষ্তিস্ক বা স্নায়ুতন্ত্র না থেকেও উদ্ভিদের কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ এমনকি দুই মাস পর্যন্ত মনে রাখা সত্যিই বিষ্ময়।”
কোনো তথ্য মনে রাখার জন্য গাছের কি প্রাণীদের মতো একটি সুগঠিত মষ্তিস্ক আছে? যেহেতু গাছের স্মৃতিশক্তির বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে, সেহেতু আপনার মনে হতে পারে গাছের মানুষের মতো মষ্তিস্ক আছে। বিষয়টি এমন নয়। কোনো তথ্য গ্রহণ, ধারণ ও তা সম্প্রসারণে গাছ ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় উদ্ভিদ কোনো একটি কাজ সম্পাদনে পুরো দেহকে যুক্ত করে। অর্থাৎ পুরো দেহে কোনো তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে অনেক সময় কোনো গাছের ৯০% ছেঁটে (প্রুনিং) ফেললেও গাছটি মারা যায় না। বরং পরবতীতে শাখা-প্রশাখা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজের দৈহিক বৃদ্ধি অব্যাহত রাখে। যদি তথ্য ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ একটিমাত্র অঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকতো, তাহলে সেই অঙ্গটি কেঁটে ফেললে গাছটি পরবর্তীতে কোনো কাজ করতে পারতো না। অর্থাৎ গাছটি মারা যেতো। তাহলে যদি স্মৃতিশক্তির বিষয়টি বিবেচনা করা যায়, তাহলে গাছের পুরো দেহ মষ্তিস্কের মতো কাজ করে। যদিও তার মষ্তিস্ক নেই এবং স্নুায়ুবিক কার্যক্রম প্রাণীদেহের মতো নয়।
গাছের স্মৃতিশক্তির বিষয়টি ভাবলে সচেতনতার বিষয়টি চলে আসে। তাহলে কী গাছ তার পারিপার্শ্বিক বিষয়ে সচেতন? যেমন তার চারপাশে ঠান্ডা না গরম, রোদ না বৃষ্টি তা কি গাছ অনুধাবন করতে পারে? গাছের বৃদ্ধিমত্তা নিয়ে যে সকল বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেন তারা এই বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। এমনকি গাছের সচেতনতার বিষয়ে মনচুসো ও তার সহকর্মীরা ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। আমরা যখন সচেতনতার বিষয়টি আলোচনা করি, তখন আমাদের তথা মানুষের সচেতনতার সাথে তুলনা করি। তবে এটা সত্য যে গাছ ও অন্যান্য প্রাণীর সচেতনতা নিয়ে আলোচনায় আপনাকে ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। এছাড়াও সচেতনতা বিষয়টি এখন অবধি বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রেক্ষাপটে বিতর্কিত বিষয়। যদি আমরা সচেতনতার বিষয় নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে এটি সত্য যে গাছ তার নিজের বিষয়ে সচেতন। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক। গাছের বৃদ্ধিকালীন সময়ে যদি উপরে কোনো বাহ্যিক ছায়াযুক্ত পরিবেশের সম্মুখীন হয় অর্থাৎ সূর্যের আলো আসতে বাঁধা দেয়, তাহলে আলোর খোঁজে গাছের দ্রুত বৃদ্ধি হয়। কারণ গাছের বৃদ্ধির জন্য সূর্যের আলো অত্যাবশ্যক, তাই এটি সূর্যের আলো পাওয়ার জন্য নিজের জৈবিক ক্রিয়ার পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তবে একটি স্বাভাবিক গাছ দেখতে বেশ শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট। কোনো একটি কান্ডের অধিক শাখা-প্রশাখার কারণে অন্য কান্ডে প্রয়োজনীয় সূর্যের আলো পোঁছাতে পারে না। তবে এক্ষেত্রে নিজের অন্য কান্ডের কারণে সূর্যের আলো পৌঁছাতে বাঁধাপ্রাপ্ত হওয়া সত্তেও কান্ডটির দ্রুত বৃদ্ধি ঘটিয়ে সূর্যের আলো উপযোগী অংশে যাওয়ার চেষ্টা করে না। এটি স্পষ্ট করে যে, গাছ তাকে কে ছায়া দিচ্ছে তা অনুধাবন করতে পারে। মনচুসোর মতে, ’নিজের কারণে, নাকি বাহ্যিক অন্য কোনো কারণে সূর্যের আলোকে বাঁধাগ্রস্থ করছে তা গাছ অনুধান করতে পারে’।
তিনি মত প্রকাশ করেন যে, বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত গাছকে সক্রিয় আত্মঅনুভূতি প্রবণ বলে প্রকাশ করেছে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে গাছ মানুষের মতো প্রতিক্রিয়া প্রদান করে। আমরা জানি যে প্রাণীকূল আত্মসচেতন। প্রাণীকূলের আত্মসচেতনতার একটি উদাহরণ হলো আয়নায় নিজেকে দেখা। কোনো প্রাণী আয়নার সামনে দাঁড়ালে বুঝতে পারে যে, সে নিজেকে দেখছে। তবে মনচুসো বলেন, এই ক্ষমতা অল্প সংখ্যক প্রাণীর আছে। মানুষ, ডলফিন, বানর ও সম্ভবত হাতির এই অনুধাবন ক্ষমতা আছে। কিছু গবেষক মনে করেন জীবজগতের স্বল্প সংখ্যক সদস্যের এই আত্মসচেনতার ক্ষমতা আছে। তবে মনচুসো এই বক্তব্যের সাথে একমত না। তিনি বলেন, ”জগতে এমন কোনো জীব নেই যারা নিজের ব্যাপারে সচেতন নয়। আমার দৃষ্টিতে পৃথিবীতে এমন কোনো জীব নেই যারা বৃদ্ধিমান না এবং সকল জীব তাদের চলার পথে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে দক্ষ”।
অনেকে গাছ নিয়ে একটি ভুল ধারণা পোষণ করেন। তারা মনে করেন, গাছ উদ্ভিজ্জ জীব যাদের যোগাযোগের সক্ষমতা নেই এবং বাহ্যিক পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা প্রকাশ করতে পারে না। তবে বিষয়টি এমন নয়। উদ্ভিদের সংবেদনশীল ক্ষমতা আছে যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। মনচুসো বলেন, গাছ প্রাণীর চেয়ে অনেক বেশি সংবেদনশীল। এই বিষয়টি মনচুসোর ব্যক্তিগত মতামত এমনটি নয়। গাছের সংবেদনশীলতার পক্ষে অসংখ্য বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে। আমরা জানি গাছের শীর্ষ মূল কমপক্ষে বিশটি রাসায়নিক ও ভৌত উপাদান সনাক্ত করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে এমন অনেক উপাদান আমরা গবেষণাগারে সনাক্ত করতে পারি না। আমাদের চারপাশে বা পায়ের নিচের মাটিতে অসংখ্য উপাদান আছি যা সনাক্ত করার ক্ষমতা আমাদের নাই। মনচুসোর মতে, “পায়ের নিচে টনকে টন কোবাল্ট বা নিকেল থাকতে পারে যা আমরা সনাক্ত করতে পারি না, অন্যদিকে গাছের মূল বিস্তৃত মাটির মধ্যে সামান্য কয়েকগ্রাম কোবাল্ট উপাদান সনাক্ত করতে পারে”।
বাহ্যিকভাবে গাছকে নিষ্ক্রিয় ও চুপচাপ মনে হলেও গাছ বিশেষ কৌশল অনুসরণ করে পারস্পারিক যোগাযোগ রক্ষা করে। অন্য জীব যেমন প্রাণীর থেকে এদের যোগাযোগ করা কৌশল ভিন্ন। মাটির উপরে অংশ (কান্ড, শাখা-প্রশাখা) এবং মাটির অভ্যন্তরের মূল দিয়ে গাছ পারস্পারিক যোগাযোগ রক্ষা করে। অনেক সময় এই যোগাযোগ নিজেদের মধ্যে হতে পারে বা অন্য জীব যেমন ছত্রাক বা অণুজীবের সাথে হতে পারে। এছাড়াও গাছ অন্য জীবের সৃষ্ট সূক্ষ তড়িৎচৌম্বকীয় সংকেত সনাক্ত করতে পারে। প্রাণীকূল যেমন নিজেদের প্রতিরক্ষায় বিভিন্ন কৌশল অনুসরণ করে, তেমনি গাছ নিজেদের প্রতিরক্ষায় বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে। এসকল পদার্থের কোনোটি শিকারীকে প্রতিহত করে, কোনো পদার্থ অন্য জীবকে আকৃষ্ট করে পরাগায়নে সহায়তা করে। উদাহরণ, ভুট্টায় ক্যাটারপিলার আক্রমণ করলে ভুট্টা গাছ এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে। নিঃসৃত এই পদার্থের ঘ্রাণের প্রতি বিশেষ প্রজাতির পরজীবী আকৃষ্ট হয় এবং ক্যাটারপিলার নির্মূল করে।
গাছ শব্দের উপস্থিতি অনুধাবন করতে পারে এবং প্রতিক্রিয়া প্রদান করে। গাছ বিভিন্ন প্রকার শব্দ সনাক্ত করতে পারে। শব্দের প্রকৃতি ভেদে গাছ বিভিন্ন প্রকার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। উদাহরণ হিসেবে ২০০ হার্জ বা ৩০০ হার্জ শব্দের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। গাছ তার শিকড় সন্নিকটে প্রবাহিত পানির ক্ষীণ শব্দ অনুধাবন করতে পারে। যদি তুমি গাছের মূলের কাছাকাছি ২০০ হার্জ বা তার কাছাকাছি কম্পাঙ্কের শব্দ উৎপন্ন করো, তাহলে গাছ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তবে শব্দের কম্পাঙ্ক ভেদে গাছ কোন প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া তৈরি করে তা জানতে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন। গাছের চারপাশে উৎপন্ন শব্দ গাছের জন্য কোনো উপকারে আসে কী না তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে মতপার্থক্য আছে। এমনকি মানুষের কথাবার্তার ফলে উৎপন্ন শব্দ গাছকে কোনো উপকার করে কী না তার ষ্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তাই মানুষের উচ্চশব্দ গাছের ক্ষতি করে, শ্রুতিমধুর শব্দ গাছের জন্য সহায়ক এমন কোনো বিষয় এখন অবধি সত্য বলে প্রমাণিত হয় নি।
গাছের বহুবিধ গুণ থাকলেও গাছে বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়টিকে অনেকে স্বীকৃতি দিতে চান না। গাছের বুদ্ধিমত্তার অন্যতম একটি কারণ হলো গাছের ধীরগতির জীবন ক্রিয়া। মনচুসোর নতুন বই ‘The Incredible Journey of Plants’এ আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন গাছ ‘ওল্ড টিজোক্কো’ সম্পর্কে জানতে পারি। ৯৫৬০ বছর বয়সী এই গাছের মূল সুইডেনের মাটিতে বিস্তৃত রয়েছে। অর্থাৎ গাছের বয়স ৯৫৬০ বছর হলেও গতি বিবেচনায় সে এখনো সুইডেনের মাটিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। একইভাবে গাছ তার উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়া অবধি নিশ্চল থাকে। এমনকি অনেক গাছের বীজ উপযুক্ত পরিবেশের আসায় বছরের পর বছর সুপ্ত থাকে। ক্রিমসন ফাউন্টন ঘাস নামক একটি গাছের বীজ উপযুক্ত পরিবেশের আসায় ছয় বছর অবধি অঙ্কুরিত না হয়ে নিষ্ক্রিয় থাকে। এই বিষয়টি অনেকে গাছের দুর্বলতা মনে করেন। তাদের মতে গাছ জ্ঞানী ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের অধিকারী হলে কখনো এত বছর নিষ্ক্রিয় বা স্বল্প পরিসরে নিজের মূলের বিস্তার ঘটাতো না। তবে মনচুসো তার বইতে খুব সুন্দরভাবে উদ্ভিদের বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করেছেন। বইটিতে উল্লেখ আছে, গাছ আদি জীব যারা বছরের পর বছর ধরে এই পৃথিবীতে টিকে আছে এবং সময়ের বাঁকে বাঁকে নতুনত্ব অন্বেষন করে চলেছে, যা মানুষের মাঝে উন্মোচিত হয়েছে।
গাছের অনুভূতি বা বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি নব্য উদ্ভিদবিদরা সাদরে গ্রহণ করেছেন। যদিও বেশ কিছু বিজ্ঞানীরা এখনও বিষয়টি স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী নন। উদ্ভিদের বুদ্ধিমত্তার বিভিন্ন বিষয় বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও তারা এই বিষয়টি স্বীকার করেন না। মনচুসো এই গোষ্টীর বিষয়ে বলেন, “এদের অধিকাংশ প্রবীণ বিজ্ঞানী। উনারা উদ্ভিদের বুদ্ধিমত্তাকে অস্বীকার করেন। তাদের মতে উদ্ভিদ আধা-জীবন্ত জৈব যন্ত্র।”
পৃথিবীতে যত জীব টিকে আছে তদের প্রত্যেকের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য, দক্ষতা আছে। জীব হিসেবে মানুষ সর্বোময় ক্ষমতার অধিকারী, অন্য জীব তুচ্ছ, মূল্যহীন এটি ভাবার সুযোগ নেই। যখন আপনি নিজেকে অন্য সকলের থেকে সেরা মনে করবেন, তখন আপনি নিজেকে সর্বোময় ক্ষমতার অধিকারী মনে করে অন্যদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে শুরু করবেন। ঠিক এই কাজটি আমরা করে চলেছি। এই জীবজগতে আমরা নিজেকে এতই ক্ষমতাশীল ভাবছি যে আমরা দানবে পরিণত হয়েছি। যদি এই পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা করেন তখন আপনি নিজের অবস্থান অনুধাবন করতে পারবেন। গবেষকদের মতে এই পৃথিবীতে জীবের বয়স প্রায় ২ মিলিয়ন থেকে ৫ মিলিয়ন বছর। আর আমরা Homo sapiens প্রজাতি পৃথিবীতে মাত্র ৩ লক্ষ বছর বাস করছি। এই স্বল্প সময়ে আমরা ইতিমধ্যে পরিবেশ ধ্বংস করে ফেলেছি। বৃক্ষ নিধন থেকে শুরু করে পরিবেশ বিপর্যয়ের সকল কর্মকান্ডের সাথে আমরা জড়িত। এই একটি বিষয়টি বিবেচনায় নিলে, কিভাবে আমরা নিজেদের জীব হিসেবে সর্বোময় ক্ষমতার অধিকারী বা সেরা জীব হিসেবে দাবি করতে পারি?






